banglarsab.com

শুক্রবার, ১২ নভেম্বর, ২০২১

কষ্টের দিন-১

                                                                             

 কেউ তো নয় একেলা সকলেই সকলের তরে বাঁধনে অন্তর্ভূক্ত বা গতানুগতিকভাবে এ ধরায় চলমান। আজ থেকে তিন যুগ পেরিয়ে গেছে। মানব জীবনে অভাবের হাহাকার কাকে বলে তাই নিয়ে আলোচনা করব, কেউ ঘৃনা করবেন না, তিনযুগ আগে গরীবদের জীবন যাপন কেমন ছিল সেই ধারনা জানতে পারা সকলের দায়িত্ব, কারন বর্তমান যুগে মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের কত সুখে রেখেছেন তা পিছনে না গেলে বুঝা যায়না। গল্প শুরু করছি। চতুর্দিকে ভাদ্র মাসের ঝনঝনানি বৃষ্টির মোহে পুরো দেশ তথা গোটা গ্রামবাসী নিস্তব্ধ। সেই আমলে বৃষ্টি মানেই  গরীবদের না খেয়ে থাকা। চলমান সাতদিন, দশদিন বৃষ্টিতে মাঠঘাট ভরে যেত, তার সাথে চলত গরীবের আহাজারি।  কোন খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহে না থাকায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্তনাদে আকাশ বাতাস কম্পিত হত। সেই সময় আমি ছিলাম সেই করুন দৈন্যদশার হিতাকাংখী। আজও মনে পড়লে গাঁ শিউরে উঠে।  মনে হয়  সেদিনগুলো আল্লাহ্ আমাদের গজব হিসেবে দানিত করেছিল। আমি তার পুরো স্বাদটা গ্রহন করেছিলাম। রাত হলে বৃষ্টির মোহে মনে হত পুরো গ্রামটা ভূতের গলিতে রুপান্তর হত, থেমে থেমে বৃষ্টি আবার কখনও লাগাতার  বৃষ্টি পড়ে থাকতো। একদা রাত দশটা হবে তবু সেটা আনুমানিকভাবে বলছি, কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে আমার বাবা শুনেই বলল কার যেন মরন হল। মা বাবাকে বললেন বাবাকে বাইরে বেরিয়ে দেখার জন্য। বাবা হতাশ হৃদয়ে বলল "নিজের পরিবার নিয়েই তো বড্ড চিন্তিত আবার অন্যের যন্ত্রণা কাঁধে নিয়ে আরও উদ্বিগ্ন বাড়াতে চাই না। মায়াবী মা আমার বাবাকে রেহাই দিলেন না। তাকে জোর করে বাইরে যেতে বাধ্য করলেন। সেই মূহূর্তটা আমার কাছে এমন ছিল যে, হায়রে কুলাংগার মানবজীন, এত কষ্টের ভারে কেউ কারো বিপদে সাড়া দিতে চায়না। কারন আমার বাবাও তো আমাদের সাত ভাই বোন নিয়ে বড্ড হাহাকারে নিমজ্জিত, আমরাও তাকে খানার জন্য তার পিছনে ঘ্যানর ঘ্যানর করছি। হতাশাক্রান্ত বাবা একটা পলিথিন মুড়ে, কাছা দিয়ে, হাতে একটা মগ বাতি নিয়ে বেরিয়ে গেল। মা অবশ্য বলেছিল আমাকে সাথে নেওয়ার জন্য, কিন্তু বাবা অতি কষ্টের সাথে বললেন না ক্ষুধার্ত ছেলেটিকে ঐ হতাশ পরিবারের হতাশ দেখিয়ে আরও বিভ্রান্ত করতে চাইনা।

বাবা চলে যাবার পর আমার তো ঘুম আসছে না, কারন দিনে শুনেছিলাম বিবির বাবা খেটে খাওয়া মানুষটি খুবই অসুস্থ তাছাড়া বৃষ্টির লাগাতার কল্যানে তো বেশ তিন/চারদিন না খেয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আমি ভেবেছি তাই হয়তঃ উনি ইন্তেকাল করেছেন। বিবি হল আমার গ্রাম্য বান্ধবী, পড়াশোনা করছে না, তবে একসাথে খেলাধূলা, একসাথে মাছধরা, একসাথে মক্তবে যাওয়া, গাছে উঠে আম পেরে খাওয়া, দৌঁড়ে বেড়ানোর সাথী। আমি বড্ড চিন্তিত হলাম, মনে হচ্ছিল আমি কি করতে পারি আমাকে যেতেই হবে। এদিকে মা ঘুমায়নি, কুপি নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছেন। আমি বিছানা ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠলাম, বাঁশের বেড়ার দরজা হালকা খুলে এক দৌঁড় দিলাম, বিবিদের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরের ভিতরে অনেক মানুষের শব্দ,কোলাহলে আমার কান্না আসছিল, ঘরে ঢুকেই দেখি বিবিসহ তার আরও দুইবোন, তিনভাই মিলে কান্নার রুল তুলেছে। বাবা আমাকে দেখে খুব কষ্ট পেলেন, কারন অন্ধকার রাতে আমি কিভাবে উপস্থিত হলাম। বিবির মাকে আমরা মাওই বলে সম্বোধন করতাম, কারন বিবির বাবার নাম আর আমার বাবার নাম একি ছিল। 'মা'ওই সাব আমায় বুকে নিয়ে সেকি কান্না গলাজুড়ে। আমার মনে হচ্ছিল, আল্লাহ্ কেন আমাদের গরীব বানাল, ভাবলাম বৃষ্টিকে ধরতে পারলে কল্লাটা ছিড়ে ফেলতাম, অতি কষ্টে মন থেকে কথাগুলো বের হচ্ছিল, আর কাদঁতেছিলাম বিবির মার সাথে অজুড়ে। এক পর্যায়ে তালই সাব অর্থাৎ বিবির বাবা হতাশ হৃদয়ে বলে উঠল 'পানি দাও পানি খাব'  তারাতারি তাকে পানি পান করানো হল। উনি অনেক লোকের সমাগম দেখে চীৎকার করে বলল, আমাকে দেখে লাভ নেই, তোমরা বৃষ্টির বিরুদ্ধে মিছিল কর, আর আল্লাহ্ কে স্বরন কর'। যাহোক এমতাবস্থায় একজনকে দেখতে পেলাম, কি যেন পুটলা বেঁধে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল। পুটলা বহনকৃত লোকটিকে সন্দেহ হল, কারন উনি সুবিধাবাদী, স্বার্থ ছাড়া কাউকে উপকার করেনা। তথাপি ক্ষনিকের জন্য সবাই আস্বস্ত হলাম, কারন একটা পরিবার অন্ততঃ হাফ ছেড়ে আজকের মত বেঁচে যাক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন