banglarsab.com

শুক্রবার, ১২ মার্চ, ২০২১

গল্প


ভুতুরে প্রচ্ছদ

 আমাদের বাড়িটা ছিল একটা বিলের ধারে নির্জন এলাকায়।  বাড়িঘর, বসতি এমন জায়গায় যে বা যারা করেন, নিতান্তই তারা বিপদে পড়েই বসতি স্থাপন করে থাকে। বাবা অলস প্রকৃতির লোক ছিলেন, খেটে খাওয়া তার জন্য নিতান্তই কষ্টের ব্যাপার ছিল। তাই তার পিতামহের দেয়া জায়গা জমি মাত্র দশ বছরেই বিক্রি করে পথে বসেছেন। অনেক কষ্টে  দিন গুজরাচ্ছি। সপ্তম শ্রেনীতে পড়ছি,  বড় ঝুট ঝামেলার মধ্যেই পড়াশোনা কোন মতে চলছে।  বিশেষ করে  আমাদের বাড়ির বর্ননা দিতে গা শিউরে উঠে। পশ্চিম পাশে মস্তবড় বিল, পূর্ব পাশে রাস্তা, উত্তর পাশে কলাবাগান, দক্ষিন পাশে ছিল, বড় ধরনের একটা শিমুল গাছ, আর অন্য বাড়ি ঘর ছিল  বেশ দুরে সেই শিমুল গাছের ছায়া আমাদের ঘরে পড়ত । রাত হলে প্রায়ই শোনা যেত কেউ শিমুল গাছের নীচে ভয় পেয়েছে। কারও চীৎকার শুনলেই বাবা লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ত সাহায্য করার জন্য। বাবা বেরিয়ে গেলে আমরা সকলে জড়ো হয়ে বসে পড়তাম, আর ভয়ে চুপচাপ হয়ে যেতাম। মা আমাদের বুঝাতেন" তোমরা জেনে রাখ এই গাছে একটা জ্বীন আছে সেটা আমাদের কোন ক্ষতি করবে না, তোমরা নির্ভয়ে চলাফেরা করবে আর ঐ গাছের নীচে  কেউ প্রসাব পায়খানা করবে না তাহলে ক্ষতি করবে। মা বড় চিন্তাশীল মহিলা ছিলেন, তার ব্যক্তিগত গতানুগতিক চেষ্টা  এবং পরিশ্রমের ফলেই আজ আমরা বেশ সুখে স্বাচ্ছন্দে দিনানিপাত করছি।আল্লাহ্ এমন মা জগতে আর দু,একটা সৃষ্টি করেছেন কিনা সন্দেহ। আল্লাহ্ যদি তাকে দশটা জান্নাত দান করেন তবুও আমার মায়ের কষ্টের সমান হবে না। কারন সে শুধু মা’ই নন বরং নানী হিসেবে যে দায়িত্ব পালন করে গেছেন সেটাও তার বিশাল অবদান। এখন উনার জন্য কি করছি, কতদুর করেছি, সেটা পরে বলব, আগে কষ্টের দিনগুলো আল্লাহ কিভাবে পার করালেন সেই গল্পই আমি করব।আমি গরীবিকে হেলা করি না, কারন আজকের ফকির কালকের বাদশা এটা বিধাতার একটা বিশাল খেলা আর  বিশাল এক্সামিন। ক্ষনজন্মা, ক্ষনস্থায়ী এ পৃথিবীতে আমরা গরীবদের হেলা করি কারন আমরা কখনও ভেবে দেখিনা আমার পূর্ব পুরষ কি ছিল, আর গরীবরাই আল্লাহ্ র প্রিয় মেহমান হয়ে কিয়ামতের মাঠে প্রথম দাওয়াতে অংশ গ্রহন করবেন। তাই আমরা গরীবকে কখনও হেলা করব না, সাহায্য করতে না পারলেও সহানুভুতি দেখাব। আমার বাবা ছিলেন, অলস প্রকৃতির ব্যক্তি। মা'র পীড়াপীড়িতেই কিছু কাজকর্ম করতেন। হয়তঃবা আবার নিজের পেটের দায়েও অনেক সময় কাজে যেতেন ঘরে একবেলার খাবার থাকলে উনি তো নাছোর বান্দা আর কাজে যেতেন না। বিশেষ করে বৃষ্টির ঘনঘটা শুরু হলে আমাদের কষ্টের সীমা  থাকতোনা।  আমি সেই সময় বাবাকে প্রশ্ন করতাম 'বাবা সবার জমিজমা আছে আমাদের নেই কেন? ' বাবা উত্তর দিতেন একটা বড় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে অনেক দেরীতে। উত্তরে শুধু বলতেন  'তোমরা বড় হলে বুঝবে এখন বুঝবে না। 

কেউ তো নয় একেলা সকলেই সকলের তরে বাঁধনে অন্তর্ভুক্ত বা গতানুগতিক ভাবে এ ধরায় চলমান। আজ থেকে চার যুগ পেরিয়ে গেছে। চতুর্দিকে ভাদ্র মাসের  ঝনঝনানি বৃষ্টির মোহে পুরো দেশ তথা গোটা গ্রামবাসী নিস্তব্দ। সে আমলে বৃষ্টি বলতেই না খেয়ে থাকা। চলমান সাতদিন দশদিন বৃষ্টিতে মাঠঘাট ভরে যেত, তার সাথে চলত গরীবের আহাজারি। কোন খাদ্য দ্রব্যের সন্ধানে বেরুতে না পেরে গরীবের আর্তনাদে আকাশ বাতাস কম্পিত হত। সেই সময় আমি ছিলাম দৈন্যদশার হিতাকাংখী। আজও মনে পড়লে গাঁ শিউরে উঠে। মনে চায় সেদিনগুলো মোদের গজব হিসেবে দানিত করেছিলেন।  যাক আমি তার পুরো স্বাদটা গ্রহন করেছিলাম। রাত হলে বৃষ্টিরমোহে মনে গ্রামটা ভূতের আড্ডায় মাতোয়ারা।  থেকে থেকে বৃষ্টি আবার কখনও লাগাতার বৃষ্টি পড়ে থাকত। একদা রাত দশটা মানে বিশাল রাত তবুও সেটা আনুমানিকভাবে উল্লেখ করছি, সজোরে কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, আমার নিদ্রা হারিয়ে গেছে ক্ষুধা আর টেনশনে। কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই বাবা বলল কার যেন মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। দরদী মা বলল, বাইরে বেরিয়ে শব্দটা কোনদিক থেকে আসছে তা শোনার জন্য। বাবা হতাশ হৃদয়ে বলল, নিজের পরিবার নিয়েই তো বড্ড চিন্তিত আবার অন্যের যন্ত্রনা কাধে নিয়ে আরও উদ্বিগ্ন হতে চাই না। মায়াবী মা আমার বাবাকে রেহাই দিলেন না, জোর করে পাঠাতে চাইলেন সেই সময়টা আমার কাছে বড় মর্মান্তিক ছিল, কারন আমার বাবা তো আমাদের সাত ভাইবোন  নিয়ে বড় চিন্তিত। আমরাও তো অর্ধহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছি, আর বাবাকে উৎপীড়ন করছি। হতাশাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে বাবা একটা পলিথিন মুড়ে, কাছা দিয়ে, হাতে মগ বাতি জ্বালিয়ে বেরিয়ে গেল। মা অবশ্য বলেছিল আমাকে সাথে নেওয়ার জন্য, কিন্তু বাবা অতি কষ্টের সাথে বললেন ‘ না  ক্ষুধার্ত ছেলেটাকে ঐ হতাশ পরিবারের হতাশা দেখিয়ে আর বিভ্রান্ত করতে চাই না। বাবা চলে যাবার পর তো আমার ঘুম আসছে না। দিনে শুনেছিলাম বিবির বাবা খেটে খাওয়া মানুষটি খুবই অসুস্থ, তাছাড়া বৃষ্টির লাগাতার কল্যানে আজ তিনচারদিন না খেয়ে তো আরও দুর্বল হয়ে পড়েছেন। তাই হয়তঃ উনি ইন্তেকাল ফরমাইছেন এজন্য সকলে কাঁদাকাটি করছে। বিবি হল আমার প্রিয় খেলার সাথী, মাছ ধরার সাথী, মোট দুজনে মিলেই হৈচৈ করেই দিন কাটাতাম। বড্ড চিন্তিত হলাম,  মনে হচ্চিল এখন কি করা যায়, আমাকে তো যেতেই হবে। এদিকে মা কুপি নিভিয়ে শুয়ে আছেন, ঘুমায়নি। আমি বিছানা ছেড়ে আস্তে আস্তে উঠলাম, বাঁশের বেড়ার দরজা হালকা খুলে এক দৌড় দিলাম, মা শুধু বলল একা যেতে পারবে তো?  শুধু হ্যাঁ বলে দৌঁড়াতে থাকলাম, একেবারে বিবিদের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরের ভিতর অনেক মানুষের কোলাহল শুনতে পেলাম, আমার দু’চোখ বেয়ে পানি পরছে, ঘরে ঢুকেই দেখি বিবি তার দুইবোন, আর তিন মিলে কান্নার রুল তুলছে। বাবা আমাকে দেখে খুব কষ্ট পেল। কারন এই অন্ধকার রাতে আমি কিভাবে উপস্থিতহ হলাম, বিবির মাকে আমরা 'মাঔ সম্ভোধন করতাম কারন  বিবির বাবার নাম আর আমার বাবার নাম এক।  কটা জবেদ আলী, আর আলসে জবেদ। এখন বুঝে নিন, কোনটা কার বাবা হতে পারে। মাওই সাব এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে সেকি কান্না, আমিও কেঁদে দিলাম, এমন মূহূর্তে আমার মনে হয়েছিল, নিছক জিন্দেগী আর নিছক দুনিয়া। কান্না কাটির মাঝেই দেখতে পেলাম এক লোক পুটলা বেঁধে কি যেন নিয়ে আসছে, মা’ওই সাহেবা তার দিকে এগিয়ে গেলেন, তাকে ঘিরেই মা’ওই অনেক কেঁদে দিলেন, তার হাত থেকে পুটলা নিয়ে তা তড়িঘড়ি খুলে দেখলেন, ভাত তরকারি। কাল বিলম্ব না করে মা’ওই প্লেট সাজাতে থাকেন, লোকটার পরিচয় পাওয়া গেল, সে আর কেউ নয়, বিবির মামা। যাহোক বাবা এবার তাদের আর কান্নাকাটি করতে নিষেধ করে, বাড়ির অভিমুখে যাত্রা করলেন, না মা’ওই সাহেবা আমাদের কোনমতেই যেতে দিচ্ছেন না তাদের সাথে খানায় শরীক হতে বাধ্য করলেন। যতটুকু খাবার উনি এনেছেন, তাতে একবেলা সবার অর্ধভোজন হবে। যাহোক প্লেট স্বল্পতার কারনে বিবিকে আর আমাকে এক প্লেটে খেতে দিলেন, দু’জন খাচ্ছি আর পরামর্শ করছি আগামিকাল ঝড় বৃষ্টি যাই থাক না কেন আমরা মাছ ধরতে নামব। যাহোক খানা শেষ করে বাবা আর আমি চলে আসলাম বাড়িতে। বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, আল্লাহ্ ছাড়া তো আমাদের আর উপকার করার মত কেউ নেই। মা শুনে বললেন কি হয়েছে, বাবা উত্তরে বললেন বিবির মামা এসেছে খানা নিয়ে, তাই সবাই খেলাম। মা শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন, কারন আমি তো কিছুটা হলেও খেতে পেরেছি।

সকালে বিবির ডাকে তন্দ্রা ছেড়ে উঠলাম, সে মাকে ফিসফিস করে কি যেন বলছে, আমার মা’ও বিবিকে ভাল জানে। মা তার কথা শুনে হাসছে। আমি উঠেই বিলে নামার জন্য  উৎসুক হয়ে পড়লাম, সাথে বিবির আরও দুইবোন মাছ ধরার যন্ত্র হল, একটা শাড়ি আর কলা গাছের ডালা দিয়ে তৈরি রশ্মি। নেমে পড়লাম, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আমরা  সকলেই কষ্টের মাঝেই আবার আনন্দে মেতে থাকি । বেশ মজা করেই মাছ ধরে চলেছি, বিবি অনেকগুলো গুড়া মাছ দেখে ভড়কে গেল, এতগুলো মাছ বড় হলে তো আমরাই একদিন তা ধরে খেতে পারতাম। তবু তো বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাদের এই কর্মশালা। বেশ দেড় দু’ঘন্টার মধ্যেই আমরা পাড়েে উঠে সোজা বিবিদের বাড়ি চলে আসলাম, তালই সাবকে বললাম মাছগুলো নিয়ে বাজারে যেতে উনি কাল বিলম্ব না করে বাজারে চলে গেলে, যে কাজটা আমার বাবার দ্বারা হত না। আমার বাবা মাছ বিক্রি করবেন তা কোনদিন হতে পারে না। যাহোক তালই সাব এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে এলন, হাসি মাখা মুখ উনি এসে আমাদের উদ্দেশে বললেনম ভালই করেছ, সবমাছ বিক্রি করে চার কেজি চাল এবং  এক প্যাক বিড়ি ও তিনি চা পরোটাও খেয়েছেন, শুনে আমরা বেশ খুশীই হলাম। চাউল দু’কেজি আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন, আমি চাউল নিয়ে দৌড় দিলাম, মা দুর থেকেই লক্ষ্য করেছে আমি পুটলা নিয়ে আসছি, তাতে মা আন্দাজ করেই বলে ফেলল,নিশ্চয় চাউল এনেছ, তাইনা বাবা?  মা চাউল দেখে বড্ড খুশী হলেন, আবার ভাঙ্গা কন্ঠে বললেন "বাবা এ কষ্ট সাময়িক, এমন এক সময় আসবে ভাত খাইতে চাইবে না"।  মা ভাত পাক করে সবাইকে পেট পুরে খাওয়ালেন। 

বৃষ্টি থামছেনা,  এটা চতুর্থদিন। বিবির ভাইবোন সকলেই মাছ ধরার পিছনে লেগে গেল। পরের দিন সকালে আমি ঘুম থেকে জাগ্রত হবার আগেই তারা বিলে নেমে পড়ে। মা আমাকে ডেকে উঠালেন,দেখেছ বিবিকে না এত ভাল জানিস, আজ তোকে ছাড়াই তারা মাছ ধরছে। আমি বিলের দিকে তাকিয়ে দেখি ঘটনা সত্য, তারা চার ভাইবোন মিলেই আজ মাছ সাবাড় করছে।  মনে খুব কষ্ট পেলাম, কারন বুদ্ধিটা তো আমার।  ঐভাবে মাছ ধরতে চারজন লাগে, আমি আর কাকে সঙ্গে নেব, আমার বোনেরা তো লাজুক, তারা না খেয়ে মরলেও বিলে নামবে না। আমি বসে চিন্তা করছি, এর মাঝেই তারা মাছের পাতিল দুজনে ধরে আংগিয়ে নিয়ে বাড়ির অভিমুখে যাত্রা করল।

আমি অসহায় এর মত তাকিয়ে শুধু দেখলাম। বিবির কাছে যাব, জেদ আর লজ্জায় মরে যাচ্ছি। বৃষ্টি তো চলছে তো চলছে। তাদের চিন্তাই আমি আমার মাথা নষ্ট। অনেক ভেবে চিন্তে গাল ফুলিয়ে বসে আছি। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম, ঠেলাজাল নিয়ে নামি, অন্ততঃ খাবার মাছটি তো ধরতে পারব। বিলে নামার প্রাক্কালে মা আমাকে অনেক নিষেধ করেছে, কারন বৃষ্টির ছোয়ায় হয়তঃ আমার জ্বর উঠতে পারে। তবুও নামলাম মাছ ধরতে।

 


      





 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন