banglarsab.com

মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১

TERRIBLE NIGHT BANGLA

 নির্জন রাত, জোসনা যেন সূর্যের মত আলো ছড়াচ্ছে। দিনে এক পশলা বৃষ্টিও পড়েছিল। হ্যাঁ আমি চাঁদনী রাতের শুভাকাংখী, কারন সেদিন আমার পকেটে দুইশত টাকাও ছিল মনে বেশ ফুর্তি ১৯৮৪/৮৫ সনের কথা, সবেই আমরা বড় গল্পে মেতে থাকি। কিন্তু না আমি বড় গল্পের পূজারী নয়, কারন আমার জীবনে ঘটে যাওয়া প্রতিটা মূহূর্তের কথা স্বরন রেখেছি, বা জনসমক্ষে তুলে ধরি, কারন সত্যটা বলা আমার তো অভ্যাস।
বেশী দীর্ঘায়িত গল্প করব না, কারন এ ডিজিটাল যুগে কেউ বড় গল্প পছন্দ করে না কারও মনের কষ্ট কেউ উপলব্দি করতে চায়না।
পাঠকগন আমার শিশুকাল আর শৈশবকাল যেভাবে কেটেছে তা কেউ জানলে শুধু মর্মাহত নয়, হার্ড এট্রাক ও করতে পারেন। আমার শৈশব কেটেছে বিভোর পল্লীতে যা পুরোটাই ছিল অভাবী সংসারের অবলীলার সন্ধিক্ষনে। বাবাকে ছোট করব না, কারন উনি যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন দু'মুঠো খাইয়ে আমাদের সন্তুষ্ট করার জন্য। কিন্তু বিধির বিধান তা হয়ে উঠেনি। তাই আমার বাবা আমাদের সাতভাইবোনের আহাজারিতে পালিয়ে বেড়াতেন।
 বড়ভাই ঢাকায় বেসরকারী ছোট একটা চাকরি করতেন।
বাবা বাড়ি নেই, আমরা ছয় ভাইবোন মা সাতজন এখন বড়ভাইয়ের কাধেঁ ভর দিয়ে চলছি। এক বড় ধরনের অভাব শুরু হল ভাদ্র মাসে অনবরত বৃষ্টির কারনে  বাবার রোজগার বন্ধ, তাই উনি উধাও হয়ে গেলেন। পনের দিন,মাস পার হয়ে গেল দরদী বাবার খবর নেই। সুদীর্ঘ তিনমাস নেই। আমাদের অনেক কষ্ট, খানাপিনা তথা পড়ালেখা বন্ধ। বড়ভাই যে বেতন পেতেন তাতে দু'শ টাকার বেশি দিতে পারতেন না। দু'বেলা খেলে দু'শ টাকায় আমাদের দশদিন চলত। আহ্ না খেয়ে থাকার দিনগুলোর কথা মনে পড়লে, আজও আমার দু'চোখ বেয়ে অশ্রু পড়ে, আত্বা হুংকার দিয়ে বলে সেসব দিনের কথা মনে করিস না হিরু। সেই সময় তো মা জননী  কোথাও যেতে পারতেন না। তবু অনেক চেষ্টা করে আমাদের একবেলা হলেও অন্ন যোগাতে চেষ্টা করতেন। মা'র সাথে জেদ করতাম না, কারন মা যদি বাবার মত হারিয়ে যায়, আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব! কে দিবে বুকে ঠাঁই। তাই হাজার কষ্টের মাঝেও মা কোথাও যেতেন না।
ভাইয়ের চিঠি এল, সে বাবাকে খুঁজার জন্য দিনাজপুর যাবে একতা ট্রেনে অমুক তারিখে,  আমাকে শহরের এক রেলষ্টেশনে থাকতে বললেন, আমাকে কিছু টাকা দিয়ে উনি আবার দিনাজপুর চলে যাবেন। তখন আমি সপ্তম শ্রেনী পড়ুয়া ছাত্র। যে ষ্টেশনে একতা ট্রেন থামবে, সেটা আমাদের বাড়ি হতে পনের কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। অর্থাত আমাদের বাড়ি থেকে আরেকটি রেলষ্টেশন যেতে হবে।
একতা এক্সপ্রেস জামালপুর থামবে। জামালপুর যাওয়ার জন্য এখান থেকে বিকেল পাচঁটায় একটা ট্রেন আছে, সেটাই যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিলাম। মা আমাকে বারবার হুশিয়ারী দিচ্ছে, আমি একা যেতে পারব কিনা?  আবার ভাই চলে গেলে একা বাড়ি ফিরতে পারব নাকি এ নিয়ে বিভিন্ন টেনশন করছেন আমার প্রানপ্রিয় মা জননী। মা খুব নামাজী এবং কোরআন পড়তেন, বলাবাহুল্য সেই আমলে আমার জানামতে কমপক্ষে একশত এর উপরে হবে মা'র কাছে মেয়েরা কোরআন শরীফ শিখতে দেখেছি।সেই মা আমাদের জন্য দোয়া করতেন আর বলতেন এ কষ্ট তোমাদের বেশিদিন স্থায়ী হবে না। সামনের দিনগুলো তোমাদের আমি খুব ভাল দেখছি, যখন আমি থাকব না। যাহোক মা আমাকে অনেক অনেক দোয়া করে কপালে ফুক দিয়ে বিদায় দিলেন, যাতে ভাইয়ের সাথে  দেখা করে ভালোভাবে ফিরে আসতে পারি। ষ্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা। মাগরিবের আজানের সময় ট্রেন এল, অনেক ভীড় ঠেলে উঠলাম, এক কোনায় দাঁড়ালাম। আধ ঘন্টার মধ্যেই জামালপুর এসে পৌঁছলাম, ট্রেন থেকে নেমে হাঁটাহাটি করছি, অপেক্ষা রাত দশটা বাজবে ট্রেন আসবে ভাইয়ের সাথে দেখা হবে। আমার ভাইটিও ছিল সোনার মানুষ, এমন ভাই পৃথিবীর বুকে আরেকজন আছে কিনা সন্দেহ। আমার ভাইটি আজও বেঁচে আছেন, আল্লাহ্ র কাছে দোয়া করছি উনার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়, কারন তার মৃত্যু যন্ত্রনা আমি সইতে পারবনা। ছয়জন ভাইবোনকে উনি ভরনপোষন করে বড় করেছেন, এমনকি বিয়ে সাদী পর্যন্ত দায়িত্ব পালনে ব্রত ছিলেন। তবে আমাদের দোয়ায় আল্লাহ্ উনাকে একটা সরকারি চাকরিও দান করেছিলেন। যা দিয়ে উনি আমাদের সংসারের পনেরো দিনের খরচ চালাতে পারতেন।মাসের  বাকি দিনগুলো বাবা-মা কষ্ট করে চালাতেন। জামালপুর ষ্টেশনে ঘুরাফেরা করছি, পেটে তো ক্ষুধার অন্ত নেই। ভাই আসবে খুচরা দুইটাকা দিবেন, সেটা দিয়ে হোটেলে পরোটা খাব, এ চিন্তায় মাতোয়ারা। মাঝে মাঝে কান্না আসছিল, হায়রে জগত, এত কষ্ট আল্লাহ আমার কপালে লিখেছিল, যাকগে না কেঁদে আল্লাহ্'র কাছে তওয়াক্কুল করে বসে আছি। কত রঙের কত মানুষ দৃষ্টিগোচর হল, তা বলে শেষ করা যাবেনা। আবার মাঝে মধ্যে হারিয়ে যাওয়া বাবার কথাও মনে উঁকি দিলে তাকেও আশেপাশে খুঁজতে থাকি। বিধির বিধান আর কেউ খন্ডাতে পারেন না। যাহোক ষ্টেশন মাষ্টারের রুমে থাকা বিশাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় দশটা বাজে, একটু পরেই ষ্টেশনে ঘন্টা বাজাল, একজনের কাছে জানতে পারলাম, একতা ট্রেন  আসছে এবার আমার মনোবল দৃঢ় করতে হবে। কারন ভাইকে খুঁজে না পেলে বড় অসুবিধা হবে, সবাইকে অনেকদিন উপোস করতে হবে। সবচাইতে বড় খুশি লাগছে দুই টাকা পাব, যা দিয়ে পরোটা কিনে খাব। ট্রেনের আলো দেখা যাচ্ছে, আমি প্লাটফর্মে শক্তভাবে দাঁড়ালাম, এবার ট্রেন ষ্টেশনে ঢুকছে ভাই চালাকি করে ইঞ্জিনের পিছনের বগিতে উঠেছেন, আর জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিয়ে আমায় খুঁজছেন, আমি ভাইকে দেখে ফেলি এমনকি তাড়াতাড়ি সেই বগির নিকট যেতে থাকি, ট্রেন  আস্তে আস্তে থেমে গেল, আমি ভাইয়ের দিকে দৌঁড়াতে থাকি আর ভাইও ট্রেন থেকে নেমে আমাকে জড়াইয়া ধরে তাড়াতাড়ি দুইশত টাকা আমার শার্টের ভিতরের পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। আর আমার হাতে দিলেন দশ টাকা হোটেলে ভাত খাওয়ার জন্য। আমি কথা বলতে পারছিলাম না, কারন কান্নায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছিলো, ভাই মুখে চুমো দিয়ে বলল আরে পাগল চিন্তা করবে না, আমি তো আছি, আর টাকাটা ভাল করে রেখ, যাতে না হারায় এই বলে ভাই আবারও ট্রেনের দিকে পা বাড়াল ট্রেনে উঠে আবারও বলল, ভাল থাকিও বোনগুলোর দিক খেয়াল  রেখো। জানেন পাঠকগন ঘটনাটি লিখছি আর কাঁদছি, আল্লাহ্ তুমি ফেরেস্তার মত ভাইটিকে মরনের আগেই বেহেস্ত রেডি করে রেখো, যাক ট্রেন ছেড়ে দিল, আমি তাকাইয়া রইলাম ভাই আড়াল না হওয়া পর্যন্ত। চোখ মুছে এক জায়গায় বসলাম মনকে শান্তনা দিলাম, ভাই তো বলেছে সে থাকতে চিন্তা করতে হবে না। অনেকক্ষন বসে থেকে ভাইয়ের দেয়া দশ টাকা দিয়ে ভাত খাব বলে হোটেলে যাবার সিদ্ধান্ত নিতেই আগে মনে পড়ল, কি দিয়ে ভাত খাব? মাছ না মাংস নাকি ডিম খাব? অনেকদিন মনে হত একটা আস্ত ডিম খেতে পারতাম। ভাবতে ভাবতে বড় ভাবনা সামনে এল, আমি হোটেলে পেট ভরে মাংস দিয়ে ভাত খাব আর আমার অন্য ভাইবোনেরা হয়তঃ রাতে অনাহারে আছে, আমি না থাকার কারনে হয়তঃ আমার মা জননী রাতে পাকও করবেন না, কোনমতে চালিয়ে দেবেন। এই ভেবে আর ভাল খানা ভক্ষন করার ইচ্ছা হারিয়ে ফেললাম। ঘুরে দেখলাম এক ঝুপড়িতে আটা দিয়ে চাপড়া ভাঁজছে তার দিকে এগিয়ে গেলাম, যা মুটামুটি আট আনার খেলেই আমার হয়ে যাবে। আট আনা পয়সা আমার পকেটে ছিল, মা দিয়েছিল, দুরে যাচ্ছি যদি কোন বিপদ হয় তাই মার দেয়া পয়সাটা দিয়েই চাপড়া কিনে খেতে লাগলাম, তাতেই অনেক বরকত উপলব্দি করলাম। এবার রাত একটার ট্রেনের অপেক্ষা। এ সময় রেলষ্টেশনে কতকিছুই না ঘটে গেল তা আর উল্লেখ নাই বা করি, কারন যা দেখেছি তা ষ্টেশনে ঘটেই থাকে। রাত বারোটা হঠাৎ খেয়াল করে পিট পিট করে স্লো গতিতে একটা ট্রেনের আলো দেখা যাচ্ছে, জানতে পারলাম মাল ট্রেন সেটা আমাদের দিকেই যাবে, প্রস্তুতি নিতে থাকি যদি কেউ উঠে আমিও উঠব, দেখি দু একজন লাফিয়ে উঠছে আমিও লাফিয়ে উঠলাম, বড়রা অবাক হল, আমার দৌঁড়ে উঠতে দেখে। কারন আমাদের চলন্ত ট্রেনে উঠার অভ্যাস আছে, কারন ষ্টেশনের কাছে বাড়ি প্রায়ই ট্রেনিং করে থাকি। মুশকিল হল লাফিয়ে উঠার অনেকেই গার্ড সাবকে একটাকা করে সেলামী দিচ্ছে, না দিলে মুশকিল আছে সামনের ষ্টেশনে স্লো না করলে কেউ নামতে পারবে না। আমি তো বিপাকে পড়ে গেলাম, আমার কাছে ভাংতি টাকা নাই, দশ টাকা দিলে যদি পুরোটাই নিয়ে যায়, এ নিয়ে ভাবছি। ভাবতেই গার্ড সাব আমার কাছে এসে মিষ্ট সুরে বলল এই ছোট সাহেব ভাড়া কোথায়? এই বলে আবার আরেকজনের কাছে চলে গেল, বাঁচা গেল আমাকে আর টাকা দিতে হল না। তবুও ভড়কাচ্ছি আবার এসে ধরে কিনা, ভয় পাই আর মা'র দোয়ার কথা মনে করি। যাক এর মাঝেই দেখতে পেলাম আমাদের ষ্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে। ট্রেন একটু স্লো করতেই অনেকেই লাফিয়ে নামতে থাকল, আমিও মা'র দোয়ার ভরসা করে নেমে পড়লাম কোন সমস্যা হল না। এবার খুঁজতে থাকি আমাদের এলাকার কাউকে পাই কিনা, না কাউকে দেখা পেলাম না,হতাশ হয়ে এক হোটেলে গিয়ে বসলাম, আর ভাবলাম দশ টাকা দিয়ে পরোটা আর ডাল ভাজি কিনব, হয়তঃ আমার বোনগুলো আর ছোট ভাইটি না খেয়ে শুয়ে আছে। ভাবতে ভাবতেই সামনে চা এল, অবাক হলাম আমি তো চায়ের কথা বলিনি, সেটা কে বলল, ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম হোটেল মালিক দিতে বলেছে, আর কিছু না বলে চায়ে চুমুক দিলাম আর ওয়েটারকে বললাম চৌদ্দটা পরোটা আর ডাল ভাজি প্যাকেট করার জন্য। ওয়েটার আমাকে জিজ্ঞেস করছে, টাকা আছে কিনা কথাটি মালিক শুনে ওয়েটারকে ডেকে কষে চড় বসিয়ে দিল গালে আর বলল, ওরা হল, এই ষ্টেশনের ভবিষ্যত কর্নধার টাকা না থাকলে যখন ইনকাম করবে, তখন দিবে। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, না কাকা আমি এইযে টাকা এখনই দিচ্ছি।মালিক বলল, দেখ আমি তোমার প্রতি খুবি সন্তুষ্ট কারন হোটেলের কাছ দিয়ে ঘুরে যাও, অথচ সাহস করে বসে কোনদিন এক কাপ চা ফ্রিতে খাওনা, তাই আজ বসা মাত্র তোমাকে চা দেয়ার জন্য বলেছি। কি করব কাকা আমরা গরীব মানুষ, চা খাব টাকা পাব কোথায়, তাছাড়া মাগনা খাওয়া ভাল নয়। যাক বাবা এতরাতে পরোটা দিয়ে কি করবে, কাকা আমার ভাইবোনগুলো সারাদিন না খাওয়া তাই নিয়ে যাচ্চি। উনি যত্ন সহকারে পরোটা ভেজে ভাল সবজি দিয়ে দিল, টাকা নিতে চাইনি আমি জোর  করে দিলাম, উনি বললেন তোমার বেশি ক্ষুধা পেলে আমার কাছে এসে খেয়ে যাবে। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দোকান থেকে বের হলাম দেখি কোনমতে যদি বাড়ি পৌঁছানো যায়,তাহলে ভাইবোনগুলো খুশিচিত্তে পরোটা খাবে আর আমার কলিজা ঠান্ডা হবে। রাত একটা বাজে বেশ চাঁদনী রাত শুই পর্যন্ত দেখা যায়। মনে সাহস আর আবেগ নিয়ে রওনা হলাম মাঠের ভিতর দিয়ে কারন কিছুদুর এগুলেই পাওয়া যাবে হযরত কাকার ছাউনি, তারপর তাকে নিয়ে বাকি পথ পারি দেব। রওনা হলাম, এখন মনে হচ্চে সামনে যদি একটা বিড়াল দৌড় দেয়, তবু আমি হার্ট এট্রাক করব। এদিক সেদিক তাকাই আর হযরত কাকাকে ডাক দেবার প্রস্তুতি নিয়ে থাকি, কিছু দেখলেই কাকাকে ডাক দেব বলে। যাকগে আল্লাহ্ র নাম জপতে জপতে কাকার ছাউনির কাছে পৌঁছে গেলাম। কাকা মাঠের ভেতর ছাউনি করে টিউবওয়েল পাহারা দেয়, যাতে চুরে না নিতে পারে। সামনে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম উনি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। বসে পড়লাম তার পায়ের কাছে। কাকার ছাউনির একটু দুরেই দুটি তালগাছ, কথিত আছে রাতে ঐ তালগাছ দুটো দুষ্ট প্রকৃতির রুপ ধারন করে, সেখানে খারাপ জ্বিন আছে, মানুষকে ভয় দেখায়। আমাকে সেই তালগাছের নীচ দিয়েই যেতে হবে সেজন্য কাকার সাহায্যের অপেক্ষায় বসে আছি। আমি কাকার দিকে তাকাতেই শুনলাম তালগাছে বিশাল বাতাস বইছে, ফিরে তাকালাম তালগাছের দিকে আশ্চর্য একটা তালগাছ যেন আরেকটা তালগাছের উপর আঁচড়ে পড়ছে মনে হচ্চে তারা মিতালী খেলছে, অবাকের সাথে দারুন ভয় লাগছে। এবার কাকাকে ডাক দিলাম, কাকা বলল, কে হিরু!  হ্যাঁ কাকা আমি হিরু। তুমি কথা বলছ না কেন আর একটু পরে হলেই চোর বলে তোমার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে বসতাম। তা এতরাতে কই থাইকা আইলা? আমি জামালপুর থেকে আইলাম। নিশ্চয় সিনেমা দেখতে গিয়েছিলে! না কাকা বাবাকে খুঁজতে গিয়াছিলাম, একথা শুনে উনি খুব মর্মাহত হলেন, আর বাবাকে গালাগালি করতে থাকেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন আমি তার কাছে ঘুমাব নাকি বাড়ি চলে যাব? বাড়ি যাব কাকা না হলে বাড়িতে মা খুব চিন্তা করবেন।আর খেয়াল করে দেখুন তালগাছ কি করছে! কাকা তালগাছের দিকে তাকিয়ে সাহসিকতার সাথে বললেন ও কিছু না বাবা আমার হাতের এই লাঠি দিয়ে দৌঁড়ানি দিলে হাতরাইয়া কুল পাবি নে। চল তোমাকে তালগাছ পার করে দিয়ে আসি, এই কথা বলা মাত্র তালগাছের আগা থেকে ঝুকা ঝুকা আগুনের ফুলকি পড়তে থাকে।  এবার কাকা থমকে দাঁড়াল, এমন অবস্থা দাঁড়াল চাচা নিজের জান বাঁচা এই মূহূর্তে কাকা কি করবে দিশে পাচ্ছে না। কাকা চিল্লাইয়া বলতে লাগল, পালাবি নাকি আমি আগুন জ্বালাইয়া নিয়ে আসব। কাকা এটা বলার পর আগুন নিভে গেল ঠিক, কাকা বলল, এইবার ডরাইছে চল আমরা আগাই। কাকা লাঠি হাতে আগে আমি পিছনে যাব এই সময় যা ঘটল তা মুশকিল।  আগুনটা আবার বিশাল আকার ধারন করে আস্তে আস্তে আমাদের দিকে আসতে থাকে।এখন তো দুজনেই বড় ভয় পাচ্ছি। উনি শুধু বলল, হিরু দৌঁড় দাও, এই বলে উনি দৌঁড় দিলেন, আমি তার পিছু নিতেই আমি তো তার মত দৌঁড়াতে পারব না। সো ভীত সন্ত্রন্ত হয়ে ছাউনির ভিতরে ঢুকে খড়ের বানানো বুন্দা যার ভিতরে আগুন আছে, সেটা নিয়ে বসে পড়লাম, আর মাকে স্বরন করলাম দোয়া কামনার্থে আর কেঁদে ফেলেছি, আর মনে হল আমি যে ছাউনির ভিতরে আছি, এটা মনে হয়, ভূত টের পায়নি, আমার কাছ দিয়েই আগুনটাৃ কাকার পিছু নিল। কাকা দৌড়াচ্ছে পিছনে আগুনের বিশাল ফুলকা যাচ্ছে আমি দেখছি, কিছু করার নেই, কাকাও কতক্ষন দৌঁড়িয়ে হয়তঃবা সারেন্ডার করে মাটিতে শুয়ে পড়ে। আমি বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখতেছিলাম। এবার আগুনের কুন্ডলী যেন কাকাকে ঘিরে নাচছে, আমি খুব টেনশন করছি, আর কাঁদছি, যার কাছে আশ্রয় নিলাম, সেই এখন বিশাল বিপদে।আর আমিতো কেঁদেই সারা আমি কি ছাউনির ভিতর থেকে বের হতে পারব নাকি এর ভিতরেই মরে থাকব, আৃমি কি বাড়ি যেতে পারব না! একটু পর দেখতে পেলাম আগুনের কুন্ডলী  আর নেই, ভাবলাম কাকার কি অবস্থা কিভাবে আমি আগাইয়া দেখব নাকি, আবার ভয়ে কাঁদছি, টেনশনে ছাউনির বাইরে বেরুতে সাহস পাচ্ছিনা। প্রায় একঘন্টা কাঁদাকাটির পর কাকার হুশ হয় আর আমাকে হিরু হিরু বলে চিল্লাইয়া ডাকতে থাকে। আমি তার ডাক শুনে আরও ভড়কে যাচ্ছি, ডাকটা সেই দিচ্ছে নাকি ভূতে দিচ্ছে তা নিয়ে সন্দিহান। কারন ভূতেরাও তার মত আমাকে ডাকতে পারে। তাই ছাউনিতেই বসে রইলাম, আমি মুরুব্বিদের কাছে শুনেছিলাম ঘর ছোট হোক আর বড় হোক তার ভিতরে ভূতপ্রেত ঢুকেনা। হঠাৎই চোখ পড়ল তালগাছের পরই মেইন রোড সেখান দিয়ে তিনচারটে হুজুর মানুষ হেটে যাচ্ছে তারা কিন্তু আমার বাড়ির দিকেই যাচ্ছে, তবে ভয় কিসের? তাদের পিছু নিতে আমার অসুবিধে কোথায়, তবে কথা হল সেই তালগাছের নীচ দিয়েই আমাকে যেতে হবে। সেখান থেকে আমার বাড়ি আর পাঁচশত গজ দূর হবে। হুজুরদের পিছু নিতে মুটামুটি চোখ বন্ধ করে তালগাছের নীচ দিয়েই দৌঁড় দিলাম, তালগাছ পার হয়ে মেইন রোডে উঠে দেখি আর হুজুরদের লেশ মাত্র নেই, আরও ভয় পেলাম এখন আরেক দৌঁড় দিয়ে একজনের ঘরের দরজায় ধপাস করে পড়ে গেলাম,বাড়িওয়ালা সম্পর্কে দাদা লাগে উনি কে কে বলে চিল্লাইতে থাকে আমি আর কথা বলতে পারছিনা, সেই ব্যক্তিও লাঠি হাতে বের হয়ে দেখে আমি দরজায় পড়ে আছি, সে আমাকে চিনে ফেলে আর বলতে থাকে এই হিরু তোর কি হইছে উঠ আমি তোর দাদা বলছি, ভয় পাইছিস নাকিরে, দাদিও বকতে থাকে ছেরাডা হয়তঃ ভয় পাইছে ওর বাবা কই জানি চলে গেছে না খেয়ে দিন যায়, তাই হয়ত ভয়ে অল্পতেই বেহুশ হয়ে পড়েছে এই বলে আমার নাকে চোখে পানি ছিটিয়ে দেয় এবার আমি আস্তে আস্তে তাকিয়ে হজরত কাকা বলে চিল্লাইতে থাকি, তখন সেই দাদার কন্ঠ শুনে হুশ হল, আর কেঁদে ফেলি। দাদাও বাবাকে গালমন্দ করে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমার রাতে বের হওয়ার কারন, বাবাকে খুঁজার কথা বললাম। উনি বলল, যাক আমার পাশে ঘুমিয়ে পড়, আমি বললাম না আমি বাড়ি যাব, উনি একটা লাঠি হাতে নিয়ে আমাকে বাড়ি আগাইয়া দিতে রওনা হলেন, মনের দুঃখে আমি কেঁদেই চলেছি। সে আগে আর আমি পিছনে হাঁটছি, আমাদের বাড়িটাও ছিল ভয়ংকর জায়গায়, তা আরেকটা জায়গায় আপনাদের অনুকূলে সন্নিবেসিত করব। যাহোক পায়ের শব্দ শুনেই মা জননী বলতে থাকে হিরু বাবা এসেছ, আমি কেঁদে কেঁদে বললাম মা আমি এসেছি, দরজা খুলে দিলেন, আমার মা অনেক ধার্মিক ছিলেন, উনি ঘুমাননি, জানেন আমি রাতেই ফিরব, কখন ডাক দেই সেই অপেক্ষায় ছিলেন। দাদা চলে গেল, আর বলল ছেরা ভয় পাইছে, তাকে গোসল করিয়ে দাও, মা ততক্ষনাত আমাকে গোসল খানায় নিয়ে গোসল করালেন, আর নানাবিধ প্রশ্ন করলেন, ভাই সম্পর্কে। গোসল সেরে ঘরে ঢুকে পরোটাগুলো বের করলাম, মা সকলকে জাগ্রত করল। সকলে জেগে পরোটা দেখে কি যে খুশি মনে হচ্ছিল, তাদের খুশিতে হয়তঃ আজ আমি বর্তমানে মহাসুখে আছি। সকলে পরোটা খাচ্ছে খুশি মনে  আমাী মনে হল, পোলাও বিরিয়ানী তাদের এই পরোটার কাছে। এর ফাঁকে মা বলল, সকলেই তোমার বড় বড়ভাইয়ের জন্য দোয়া কর, সে যেন ভালভাবে দিনাজপুর পৌঁছে যায়, আর তোমার বাবাকে খুঁজে পায়। টাকা দুইশত মা'র হাতে দিলাম, আপাততঃ দশদিনের খাবার ঘরে এল। আমি কিন্তু ভাল ছাত্র ছিলাম, ক্লাশে ফাষ্ট বয়, কিন্তু ক্ষুধার তাড়নায় প্রায়ই স্কুলে যেতাম না। স্যারেরা অনেক সময় বাড়ি পর্যন্ত এসে আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন।

রাতে ঘুম হয়না, কারন ছোট্র একটা বাড়ি পুরুষ বলতে আমি একাই সে বাড়িতে। হতাশা আর ভয় নিয়ে সারারাত জাগ্রত থাকি,  গাছের একটা পাতার শব্দ হলেও আমি বলতে পারতাম কোন গাছের পাতা পড়ল! বা কি হল, সেখানে রাত হলে মনে হত বাঘ হতে শুরু করে ভূতপ্রেতের অভাব ছিল না সবকিছুর ভয় বিদ্যমান। তাই সবসময় একটা কুপি আর ম্যাচ কাছে রাখতাম। তিনদিন হল, ভাই কোন সময় এসে দরজায় লক করে তারও অপেক্ষা। 

চতুর্থদিন রাতে ঘুম হত পগারপার, শুধু টেনশন করছি ভাই কখন আসবে, ভাই অবশ্য রাতে বাড়ি আসলে প্রথম আমাকেই ডাকে। রশিদ রশিদ বলে দু'তিনটে ডাক দেয়। মা'র অর্ডার তিন ডাক পার হলে জবাব দিতে হবে, বুঝতে হবে এটা মানুষ। নচেৎ দু'বা এক ডাক দিয়ে  চুপ হয়ে গেলে সেটা বুঝতে হবে ভুত। এ শিক্ষা মা'র কাছ থেকে পাওয়া। ঐ বাড়িতে কখনও বাবার নাম ধরে, কখনও ভাইয়ের নাম ধরে, আবার কখনও আমার নাম ধরে এক ডাক, দুই ডাক দিয়েছে কতশত আমরা কখনও বের হইনি। ফলে দেখা গেছে সেটা আসলেই মানুষ নয়, কারন আমরা জানালার ফাঁক দিয়ে দেখেছি কিচ্ছু দেখা যায় না। সে রাত তো মোটেই ঘুমাতাম না। যাহোক অনেক কিছু কল্পনা করছি শুয়ে শুয়ে।  হঠাৎ শুনতে পেলাম রাস্তা থেকে কথা বলতে বলতে কারা যেন রাস্তা থেকে নামল, আর ভিতরে ঢুকেই এক ডাক দিল, রশিদ, আমি আরও ডাকের অপেক্ষায় থাকলে মা বলল, তোমার ভাই এসেছে, দরজা খোল। তার মানে মা জননীও ঘুমাইনি এটাই বাস্তব। আমি আগে হুট করে কুপি জ্বালালাম, তারপর দরজা খুলতেই ভাই বলে উঠল, দেখ বাবাকে নিয়ে এসেছি। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম ভাইবোন সকলে উঠে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না! সেই কান্নায় মনে হয় আল্লাহ্ র দরবার এ আমাদের ভবিষ্যৎ সুখ মন্জুর হয়েছিল। মা জননী শুয়ে শুয়েই কাঁদছেন, উঠতে বিলম্ব করছেন, তাই বড়ভাই মাকে শর্ত জুড়ে দিল, মা উঠ কতদিন তোমার হাতের খাবার খাইনা। এই কথা শুনে মা আর শুয়ে থাকতে পারল না উঠে এসে বলল, হাতমুখ ধুয়ে এসো আমি খাবার দিচ্ছি। এ কথা শুনে আমি অবাক হলাম, কারন আমরা তো রাতে বউখুদ ভাজি খেয়ে শুয়েছি মা ভাত পাবে কোথায়!!  মা জননী কখন জানি ভাত পাক করে রেখেছে ভাই আর বাবা আসবে বলে আর না আসলে সকালে আমাদের সেগুলো পানিভাত হিসাবে সারাদিন চালিয়ে দিত। যাহোক খেতে বসে বাবা ভাইবোন সকলকে সংগে নিল, দুএক লোকমা যা ভাগে পড়ল, তাই সকলে খেলাম।

 এভাবেই বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আবারও দুঃখ কষ্টের সংসার কোনক্রমে চলতে থাকল। সেই বড়ভাই আমাকে আজ অন্তর থেকে ভাল জানেনা, সেটা হল ভাবীর কারনে। আমি সেই বড়ভাইকে আজীবন দোয়া করব, শ্রদ্ধা করি পীরের মত, আল্লাহ্ যেন মৃত্যুর আগে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দেন। হে আল্লাহ্ তুমি আমার ভাইকে নেক হায়াত দান কর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন